২ ডিসেম্বর ২০০৭, আইফেল টাওয়ারের শহর সাজে নতুন সাজে। প্যারিসের আকাশের মতো প্যারিসের মাটিতেও বসে তারকার মেলা। বিশ্বের সব তারকা ফুটবলার, কোচ সবাই একই ছাদের নিচে যেন আলো ছড়াচ্ছেন। আর সারা দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীরা সেই আলো গায়ে মেখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেরা তারকাকে দেখার। চলছে নানা প্রেডিকশন, নানা যুক্তিতর্ক। কারো মতে ব্যালন জিততে যাচ্ছে ১৯ বছরের তরুন আর্জেন্টাইন মেসি কেউবা ভাবছে এবার ব্যালন নিশ্চিত পর্তুগিজ স্টার ক্রিস্টিয়ানোর। অনেকেই আবার ধারণা করে বসে আছে প্যারিসের আকাশ নাচবে সাম্বার তালে।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তিনবারের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবল সম্রাট পেলে আসলেন শ্রেষ্ঠ তারকার নাম ঘোষণা করতে। চিৎকার করে তিনি কাকা নামটাই বললেন । করতালিতে মুখর হলো পরিবেশ আর সেই করতালির আওয়াজ পৌঁছে গেল সারা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের কানে। হ্যাঁ! প্যারিসের আকাশ সেদিন সাম্বার তালেই নেচে উঠেছিল। ৬ষষ্ঠ এসি মিলান প্লেয়ার হিসেবে কাকা জিতলেন ব্যালন ডি অর। একই বছরে ইউরোপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কারেও যে চুমু এঁকেছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান।
এতক্ষণ যাকে ‘কাকা’ নাম ডাকা হচ্ছে সেটা কিন্তু তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম ‘রিকার্ডো আইজেকসন দস সান্তস লেইতি’। এই কাকা নামের হয়ে উঠার পেছনে একটা রহস্য আছে। ছোট ভাই রদ্রিগো বড় ভাইয়ের ‘রিকার্ডো’ উচ্চারণ করতে না পারায় তাকে ‘কাকা’ নামে ডাকতেন। সেখান থেকেই সবার মুখে মুখে চলে যায় এই নাম। ১৯৮২ সালের ২২ এপ্রিল ব্রাসিলিয়াতে জন্ম নেয়া কাকার কৈশোর কেটেছে সাও পাওলোতে। ৭ বছর বয়সেই সেখানকার এক ফুটবলক্লাবে ভর্তি হন কাকা। তবে টেনিসের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো অনেক কিন্তু শেষমেশ ফুটবলেই নজর দেন এই ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারকিড।
সাও পাওলোতে প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু আর প্রথম বছরেই নজর টানা পারফরম্যান্স করেন। পুরস্কারও হাতেনাতে ২০০১ সালে বলিভিয়ার সাতজে ম্যাচে হলুদ জার্সিতে অভিষেক, ছিলেন ২০০২ এর বিশ্বকাপজয়ী দলেও। চুমু এঁকেছিলেন প্রত্যেক ফুটবলারের স্বপ্নের ট্রফিটাতে। এরপর ২০০৩ সালে ৮.৫ মিলিয়নে এসি মিলানে পাড়ি জমান। প্রথম সিজনেয় করেন ১০ গোল, করেন কিছু গুরুত্তপূর্ণ এসিস্ট আর তাতেই ২০০৪ সালের এসি মিলানের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা হাতে উঠে। এরপর ২০০৫ ও ২০০৬ ব্যালন লিস্টে ৭ম ও ৬ষ্ঠ পজিশনে ছিলেন। তবে ২০০৬/০৭ মৌসুমে ইউসিএলে সর্বোচ্চ ১০ গোল ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসিস্ট করে দলকে জিতান চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফি। মিলানে ১৯৩ ম্যাচে ৭০ গোল করেন এই মিডফিল্ডার, এরপর রিয়ালে ৮৫ ম্যাচে করেন ২৩ গোল।
হলুদ জার্সিতেও তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ২০০১ এ অভিষেকের পর ৯২ ম্যাচ খেলে করেন ২৯ গোল। ২০০৫ ও ২০০৭ এ ব্রাজিলের কনফেডারেশন কাপ জয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ২০০৩ ও ২০০৭ এ ‘সিরি এ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ আর ২০০৭ এ ব্রাজিলের সাম্বা ডি অর পুরস্কার জিতেন এই মিডফিল্ডার। ২১ শতকের একমাত্র ব্রাজিলিয়ান হিসেবে তিনি জায়গা করে নেন ‘মারাকানা হল অফ ফ্রেম’ এবং ‘মিলান হল অফ ফ্রেমে’। কাকা ছিলেন একজন বুদ্ধিমান, ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার। নিজে যেমন গোল করেছেন নিখুঁত ফিনিশিংয়েও তেমনি গোল করিয়েছেন। তার একসিলেরেইশন, ড্রিবলিং, লং নিখুঁত পাস, স্কিল আর নিখুঁত ও পাওয়ারফুল শটই ছিলো তার মূল শক্তি। ফুটবল পায়ে তিনি একজন দক্ষ শিল্পী।
বীরেরা শুধু নিজে পথ তৈরি করে না বরং তারা পথ দেখায়ও। তেমনই এক উদাহরণের নাম কাকা। ফুটবলের পাশাপাশি সবসময় মানবসেবায় কাজ করে গেছেন এই লিজেন্ড। ফলস্বরূপ ২০০৪ সালে সর্বকনিষ্ঠ মানব হিসেবে জাতিসংঘের ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী’র দূত মনোনীত হন। এরপর ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মানবসেবার স্বীকৃতিস্বরুপ ‘টাইমস ১০০’তে জায়গা করে নেন এই ব্রাজিলিয়ান। তিনি শুধু একজন গ্রেট ফুটবলার নন একজন গ্রেট মানুষ হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। আর এ জন্যই তিনি বিশ্বের খুব অল্পসংখ্যক হেটারলেস প্লেয়ারদের মাঝে একজন।
সম্পাদনাঃ মোঃ এহসানুল কবীর
0 Comments